Sunday, September 4, 2016
ঢাকার বয়স কত
উত্সব আয়োজনে বর্ণিল হয়ে ওঠা রকমারি উদযাপনে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত একটি প্রপঞ্চ ‘চারশ বছরের ঢাকা’। এ ডামাডোলে হারিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার প্রকৃত বয়স। সাভারে রাজা হরিশচন্দ্রের ঢিবি থেকে আরম্ভ করে এ শহর ও আশপাশের অনেক প্রাচীন কীর্তি এবং ইতিহাস যে তথ্য তুলে ধরছে, তাতে ঢাকার হাজার বছরের অতীতের কথা জানা যায়। সেক্ষেত্রে ‘ঢাকার চারশ বছর’ শিরোনামে রচনাগুলো আমাদের আজকের রাজধানীর অতীতকে সংক্ষিপ্ত করে তার গৌরব অনেক ক্ষেত্রে মলিন করে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকার ইতিহাস নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণে ভিত্তি করে বাস্তবসম্মত যেসব গবেষণা করা হচ্ছে, তাতে কিন্তু ঢাকার প্রকৃত বয়স যে অন্তত হাজার বছর, তার ঢের প্রমাণ মেলে। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা সম্ভব রাজধানী ঢাকার বয়স কত আর এর ঐতিহ্যের শিকড়টা ইতিহাসের কতটা গহিনে প্রোথিত।
ইতিহাস বিচার করতে গেলে আমরা দেখি ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ প্রথমত বাংলায় একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর তার হাত ধরেই সোনারগাঁয়ে শুরু হয় ২০০ বছরব্যাপী বাংলার স্বাধীন সালতানাতের যাত্রা, যা দিল্লির সালতানাত থেকে ছিল পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, এক কথায় বিদ্রোহী। এ সময়কাল থেকেই একটি ছোট্ট শহর হিসেবে ঢাকার অস্তিত্ব ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়, যা কালক্রমে বিকশিত হয়ে আমাদের আজকের রাজধানী শহর— যানজট, আবাসন সংকট আর নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও সবার ভালোবাসা ও গর্বের ঢাকা। ইতিহাসের সূত্রের দিকে দৃষ্টি দিতে গেলে ১৭ শতকের শুরুতে অর্থাত্ ঢাকায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠার আগে বাহারিস্তান-ই-গায়েবিতে মির্জা নাথান ঢাকার যে অবস্থার বর্ণনা করেছেন, তা অনেকটা এমন— বুড়িগঙ্গার পূর্ব তীরে প্রতিষ্ঠিত একটি সুন্দর নগরী ছিল, যা ছিল অনেক জাঁকজমকপূর্ণ। ইতিহাসকে ভিত্তি করে এর অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করা হলে বর্তমান বাবুবাজারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে কয়েক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এ সুন্দর নগরটি, যাকে আমরা ঢাকা নামে চিনি।
সেন আমলের কথা ভাবলে দেখি, বর্তমান পুরান ঢাকার অনেক স্থানের নাম হিন্দু নামে দীর্ঘকাল ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে, যা এখানে প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু বসতি ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে স্থানটির পরিচিতি প্রদান করে। ইতিহাস ও সাহিত্যিক সূত্রেও এমন প্রমাণ পাওয়া যায়। ঢাকাবিষয়ক অন্যতম চিন্তাবিদ ও ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের গুণী ব্যক্তিত্ব হাকিম হাবিবুর রহমান উর্দু ভাষায় লেখা তার ‘ঢাকা পাচাস বরস প্যাহলে’ গ্রন্থে বলেছেন, বিক্রমপুর যখন সেন রাজাদের রাজধানী, তখন থেকেই ঢাকার দক্ষিণাংশে হিন্দু বসতি গড়ে উঠতে শুরু করে, যা প্রচলিত ধারার ইতিহাস চর্চাকারীদের চিন্তাধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তত্কালীন সময়ের স্মৃতি হিসেবে আমরা বর্তমান রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার নামকরণ লক্ষ করি। এসব অঞ্চলের নামকরণের কারণ অনুসন্ধানে ইতিহাস বিশ্লেষণ, প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ কিংবা জাতিতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রভৃতি ঢাকার প্রকৃত প্রাচীনত্বের সূত্রের সন্ধান দেয়।
লক্ষ্মীবাজার, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, জালুনগর, বানিয়ানগর, গোয়ালনগর, তাঁতীবাজার, সুতারনগর, কামারনগর, পাটুয়াটুলি, কুমারটুলি ইত্যাদি এলাকার নামকরণের কথা বলা যায়। এ নামগুলো মোগল-পূর্ব যুগে হিন্দু প্রভাবাধীন নানা পেশাজীবীর ঢাকায় অবস্থান প্রমাণ করছে। রাজধানী সোনারগাঁয়ের নিকটবর্তী হওয়ায় বাণিজ্য বিস্তার করতে গিয়ে ঢাকার এ অঞ্চলে ক্রমে নাগরিক জীবনের বিস্তার ঘটে। সোনারগাঁ থেকে ঢাকার নগরায়ণের পথ প্রশস্ত হয় নদীপথের যোগাযোগ থাকায়। প্রাক-মোগল যুগে ঢাকার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমা নির্ধারণ করে যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা এবং ধোলাইখাল। সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাবে প্রাক-মোগল ঢাকার পশ্চিম সীমানা নির্ধারণ করা কঠিন। ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খাঁ বার ভূঁইয়াদের পরাজিত করে ঢাকায় মোগল রাজধানী প্রতিষ্ঠা করার আগেই বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার অঞ্চলে ‘ঢাকা দুর্গ’ নামে একটি দুর্গ ছিল। দুর্গের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা তীরের ঘাটটির নাম ছিল চণ্ডীঘাট। বাহারিস্তান-ই-গাইবির বক্তব্য অনুযায়ী, এ অংশে তখন দুটি অঞ্চলের বিকাশ ঘটে। এ চণ্ডীঘাটটিই পরে চকবাজার নামে পরিচিত হয়। দুর্গ থেকে চণ্ডীঘাট পর্যন্ত বাজারের বিস্তার ছিল। ঢাকা নগরীর বিস্তারের যুগে ইসলাম খান (১৬০৮-১৬১৩ খ্রি.) এখানে রাজধানী স্থাপন করেন এবং সম্রাটের নাম অনুসরণে এর নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। এক শতকের চেয়ে সামান্য বেশি সময় ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ সময় প্রশাসনিক বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিকাশ অব্যাহত থাকে।
ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্বের প্রাচীনত্ব অনুসন্ধান করতে হলে সোনারগাঁয়ের দিকেই ফিরে তাকাতে হয়। সেন শাসন যুগে বিক্রমপুর যখন রাজধানী, তখন ঢাকার কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল সোনারগাঁ। সোনারগাঁ কেন্দ্রের অবস্থান শীতলক্ষ্যা নদীর আনুমানিক আট কিলোমিটার পূর্বে। বখতিয়ার খলজির হাতে নদীয়া পতনের আগে সোনারগাঁ ছিল সেনদের অন্যতম শাসনকেন্দ্র। নদীয়া থেকে বিতাড়িত লক্ষ্মণ সেন বিক্রমপুরে চলে আসার পরও সোনারগাঁ গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। ফার্সি গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরির লেখক মিনহাজ-ই-সিরাজের বর্ণনা অনুযায়ী ১২৬০ খ্রিস্টাব্দেও ‘বঙ্গ’ লক্ষ্মণ সেনের উত্তরসূরিদের শাসনাধীনে ছিল। তবকাত-ই-নাসিরিতে সোনারগাঁয়ের নাম উল্লিখিত হয়। মধ্যযুগের শুরু থেকেই সোনারগাঁ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র। ঢাকা যে ফখরউদ্দিন মুবারক শাহের শাসনকাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ শাসনকেন্দ্র হিসেবে নিজ অবস্থান তৈরি করেছিল, ঢাকা নগরীতে প্রাপ্ত দুটি শিলালিপি তার সাক্ষ্য দেয়। শিলালিপিতে উত্কীর্ণ তারিখ ফখরউদ্দিনের সময়কালের শতাধিক বছর পরের। কিন্তু লিপি বক্তব্যের সূত্রে পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৬-১৪৫৯ খ্রি.) সময় উত্কীর্ণ এ শিলালিপি দুটির একটি থেকে স্পষ্টতই ধারণা করা যায়, ঢাকা তখন ‘ইকলিম মুবারকাবাদের’ অন্তর্গত ছিল। ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ স্বাধীনতা ঘোষণার পর সোনারগাঁ রাজ্যের অন্তর্গত ‘ইকলিম মুবারকাবাদ’ নামটি ব্যবহার হতে থাকে। মুবারকাবাদের অবস্থান সম্পর্কে এইচ ই স্টাপলটন যে ধারণা দিয়েছেন, তার উদ্ধৃতি পাওয়া যায় ড. আহমদ হাসান দানীর বক্তব্যে। দানীর বক্তব্যে পূর্ব বাংলার একটি বড় প্রশাসনিক অঞ্চল ছিল মুবারকাবাদ। সুলতানি বাংলার শিলালিপিতে দুটি ইকলিম অর্থাত্ প্রদেশের নাম পাওয়া যায়। একটি ইকলিম মুয়াজ্জমাবাদ, যা বর্তমান সোনারগাঁয়ের পূর্ব-উত্তরে মহজমপুর থেকে শুরু করে ময়মনসিংহ অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর অন্যটি ইকলিম মুবারকাবাদ। ইকলিম মুবারকাবাদ নামাঙ্কিত শিলালিপিটি পাওয়া গেছে বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারের কিছুটা পশ্চিমে গিরিদাকিল্লা নামের মহল্লায়— নাসওয়ালা গলি মসজিদের সামনের একটি তোরণের গায়ে। মসজিদ আর তোরণের অস্তিত্ব এখন নেই। শিলালিপি সূত্রে জানা যায়, মসজিদটি ৮৬৩ হিজরি অর্থাত্ ১৪৫৯ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটি সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হওয়ায় সমকালীন সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের নাম উত্কীর্ণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে খাজা জাহান নাম লেখা হয়েছে। আর নির্মাণ অঞ্চল হিসেবে লেখা হয়েছে ‘ইকলিম মুবারকাবাদ’। অর্থাত্ পনেরো শতকের মাঝপর্বে পুরান ঢাকা ইকলিম মুবারকাবাদের রাজধানী ছিল এবং গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন খাজা জাহান উপাধিধারী কেউ।
বাংলায় স্বাধীন সালতানাতের অবসান ঘটে ১৫৩৮ সালে। এ সময় শেষ স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ মোগল সম্রাট হুমায়ুনের কাছে পরাজিত হন। কিন্তু বাংলায় মোগল আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। হুমায়ুন গৌড় অধিকার করে মাত্র ছয় মাস টিকে থাকতে পেরেছিলেন। এ পর্যায়ে বিহার অঞ্চলের আফগান শাসক শের খান হুমায়ুনের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। ১৫৩৯ সালের জুলাইয়ে হুমায়ুন বিতাড়িত হন। বাংলা আফগান শাসনের অধীনে চলে আসে। দিল্লির মোগল শাসন যুগে বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে একধরনের স্বাধীন অঞ্চলে পরিণত হয়। এভাবে দীর্ঘকাল বাংলা মোগল অধিকারের বাইরে থেকে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছিল। ভাটি বা নিচু অঞ্চল বলে পূর্ববাংলা বরাবরই বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ পেয়েছে। স্বাধীন সুলতানি যুগের পরও তাই পূর্ববাংলা তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকে ছিল। এ পর্বে পূর্ববাংলায় একক কোনো রাজ্য গড়ে ওঠেনি। অনেক বড় বড় জমিদারের অধীনে বিভক্ত ছিল বাংলার এ অংশটি।
এরা সাধারণভাবে ‘বার ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। এ বার ভূঁইয়ারা একযোগে মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সম্রাট আকবরের আমলে বার ভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান মসনদ-ই-আলা। মোগল সুবাদার ইসলাম খানের ঢাকা দখলের সাধারণ কারণ বার ভূঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা। মোগলরা উত্তরে তাণ্ডা থেকে পূর্ববাংলার দিকে অগ্রসর হয়। পথে অনেক জমিদার মোগল বশ্যতা স্বীকার করে। বার ভূঁইয়াদের শেষ ঘাঁটি শীতলক্ষ্যা নদী। সোনারগাঁয়ের কাছে কাতরাবোতে ছিল মুসা খাঁর শাসনকেন্দ্র। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত মোগল জলদুর্গ হাজিগঞ্জ দুর্গ শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত। হাজিগঞ্জ দুর্গ বরাবর নদীর পূর্বপাড়ে নবীগঞ্জ। এখানেই ছিল মুসা খানের সামরিক ছাউনি। আর শীতলক্ষ্যা নদীতে ছিল বার ভূঁইয়াদের রণতরী। তাই বার ভূঁইয়াদের শেষ শক্তিতে আঘাত করার জন্য এর কাছাকাছি অঞ্চল ঢাকাকে বেছে নিতে হয়েছে মোগল সুবাদারকে। মোগল আগমনের আগে ঢাকার নাগরিক জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ এখানে উল্লেখ করা যায়। আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় একটি দুর্গ ছিল। আফগানদের বা স্থানীয় জমিদারদের গড়া এ দুর্গ। ঢাকা দুর্গ নামে পরিচিত এ দুর্গ সংস্কার করে এখানে সুবাদার ইসলাম খাঁর আবাসস্থল বানানো হয়। এ দুর্গ মোগল অধিকারের আগে ঢাকার নাগরিক জীবনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঢাকা অধিকারের পর ইতিমাম খাঁ ও মির্জা নাথানকে ডেমরা খালের মোহনার দুই পাশে অবস্থিত বেগ মুরাদ খাঁর দুর্গ দুটির দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। এ বর্ণনায় ঢাকার অভ্যন্তরে ঢাকা দুর্গ এবং উপকণ্ঠ ডেমরায় দুটি দুর্গের অবস্থানও বার ভূঁইয়াদের সময় ঢাকার গুরুত্বকে নির্দেশ করে।
তিনটি প্রাদেশিক কাঠামো বা ইকলিমের মধ্যে ১৩৩৮ সালে সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলা দিল্লির নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুরু হয় বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন। দিল্লির শাসন কাঠামো থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকার পরও এই কালপর্বেই বাংলায় শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সার্বিক বিকাশ ঘটে। সুলতানি পর্বে পূর্ব বাংলায় সোনারগাঁ ও উত্তর বাংলার গৌড় বা লক্ষৌতি ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার রাজধানী। গোটা বাংলায় সুলতানি যুগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। ঢাকা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহের বারবাজার, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া সুলতানি স্থাপনা ও লিপিসাক্ষ্য এর প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। দীর্ঘ বিরতির পর ১৬০৮ থেকে ১৬১০-এর মধ্যে মোগল সুবাদার ইসলাম খাঁর হাতে ঢাকার পতন এ স্বাধীনতার চূড়ান্ত অবসান ঘটায়। বাংলা পরিপূর্ণভাবে মোগল সুবার অন্তর্ভুক্ত হয়। সুবাদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে বাংলা সুবার রাজধানী করেন। সম্রাটের নামে ঢাকার নাম রাখেন জাহাঙ্গীরনগর। এভাবে প্রায় আড়াইশ বছর পর বাংলা আবার দিল্লির প্রদেশে পরিণত হয়। আর দ্বিতীয়বারের মতো প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পায় ঢাকা।
অনেকে বলেন, ঢাকা নগরীর বর্তমান বয়স রাজধানী হিসেবে ৪০০ বছর। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণনির্ভর সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে আমরা যে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছি, তার আলোকে দেখতে গেলে প্রায় ৮০০ বছর আগেই ঢাকায় নাগরিক জীবনের সূচনা ঘটে এবং লিপিসাক্ষ্যে স্পষ্ট যে, প্রায় ৬০০ বছর আগে সুলতানি যুগে স্বাধীন বাংলার একটি ইকলিম বা প্রদেশের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থান থেকে শুরু করে ঢাকার আশপাশে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলো রাজধানী ঢাকার ইতিহাসকে পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার বছর। বিশেষ করে ঢাকার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বঙ্গ জনপদের ইতিহাসকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেসঙ্গে জনপদের যুগে বাংলাদেশের ইতিহাসকেও প্রতিতুলনা করার চেষ্টা করতে হবে। এভাবে হিসাব করলে রাজধানী ঢাকার প্রকৃত বয়স মাত্র ৪০০ বছর নয়, কয়েক হাজার বছরের। সাভারের রাজাসন, হরিশচন্দ্র রাজার ঢিবি থেকে শুরু করে ডগরমুড়া প্রত্নস্থানের ঐতিহাসিকতা যেহেতু বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু রাজধানী ঢাকার ইতিহাস রচনা করলে অবশ্যই কমপক্ষে পাল যুগ থেকে শুরু করতে হবে। আর সেভাবে চিন্তা করলে রাজধানী ঢাকার ইতিহাসকে পিছিয়ে নিতে হবে আট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এতে স্বাভাবিকভাবেই রাজধানী ঢাকার বয়স গিয়ে দাঁড়াচ্ছে কমপক্ষে হাজার বছরেরও বেশি।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment