অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা
ভুমিকাঃ
কিছুদিন আগে আমি আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত একজন শিক্ষকের কাছ থেকে একটি ই-মেইল পাই, যাতে তিনি জানান, তিনি “বাংলাদেশে উচচশিক্ষার মান নির্ধারনে” কাজ (স্টাডি) করছেন । আর এই প্রয়োজনে আমি যেন তার পাঠানো একটি প্রশ্নপ্রত্রের উত্তর দেই । প্রশ্নপত্রে ৮টি প্রশ্ন ছিল যার উত্তরে আমি ঐসব বিষয়ে “কি মনে করি” তা জানাতে বলা হয়েছে । প্রশের মধ্যে ছিল, কোর্স কারিকুলামএর উন্নয়ন এ কাজে সব চেয়ে বেশী দরকারী কি না, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তার ঘোষিত লক্ষে্র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, শিক্ষার প্রধান এবং ব্যবহারিক লক্ষ ভালোভাবে বর্ননা করা হয়েছে কি না, শিক্ষকগন এই বিষয়ে সম্যক অবগত কিনা, কোর্সগুলি ভালভাবে বর্ননা করা হয়েছে কিনা, ছাত্ররা এসব থেকে কি উপকার পাবে তা বলা হয়েছে কিনা, কোর্স প্রনয়নের সময় ছাত্রদের যুক্তি ও চিন্তা শক্তি বাড়ানোর সু্যোগ রাখা হয়েছে কিনা, ছাত্রদের মুখস্থ করে ভালো নম্বর পাওয়ার উপর বেশী গুরুত্ব দেয়া হয় কি না, ইত্যাদি । এটি যদি কোন ছাত্রের ক্লাশের এসাইনমেন্ট হতো তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিয়ে দিতাম । আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছিলাম যে, যুক্তরাষ্ট্রে সবকিছু এত গুরুত্বহীন বা দায়সারা ভাবে করা হয় কি না, অথবা আমার উত্তরের উপর নির্ভর করে তারা ভূল তথ্য পাবে কি না । তাই আমি উত্তর দানে বিরত থাকি । এর কয়েকদিন পরে আমার কাছে স্থানীয় ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পাঠানো হয়, যাতে এই প্রশ্নপত্রের উল্লেখ ছিল । এটিকে উল্লেখ করা হয়েছে “মজার তথ্য (ফাইন্ডিং)” বলে। বলা হয়েছে, উত্তরদাতাদের ৮০-৯০% ভাগ মনে করেন, কোর্স কারিকুলামের উন্নয়ন প্রয়োজন, ৬১% ভাগ মনে করেন, মুখস্থবিদ্যাই ভালো ফলের কারন, ৫০% ভাগ শিক্ষক শিক্ষাদানে উন্নতির জন্য কোন চেষ্টাই করেন নি, ৯০% ভাগ শিক্ষকের শিক্ষন সম্বন্ধে প্রশিক্ষনের ঘাটতি আছে, ইত্যাদি । এই সঙ্গে শিক্ষন বিষয়ে প্রশিক্ষনের প্রয়োজন সম্বন্ধে এই বিষয়ের শিক্ষকগন সেমিনারে যেসব কথা বলে থাকে তার কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে যা বলা হয়েছে তার মানে দাঁড়ায়, “বাংলাদেশে উচচশিক্ষার মান উন্নয়নে বিদেশে কর্মরত এই বিষয়ের শিক্ষকদের সেবা প্রয়োজন” । আমার প্রশ্ন হল, বিষয়টি কি এতই সোজা ?
বাংলাদেশে উচচশিক্ষার মান নির্ধারনের জন্য অনুসন্ধানঃ
বাংলাদেশে উচচশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রথম কাজ হবে এই শিক্ষার বর্তমান মান সম্বন্ধে জানা । সেটা কোনভাবেই কিছু সংখ্যক শিক্ষকের মতের উপর নির্ভর করে হতে পারে না । এজন্য প্রয়োজন দেশের ভেতরেই নিয়ম মাফিক অনুসন্ধান । তবে, অনুসন্ধান ছাড়াও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় অভিজ্ঞ যে কোন শিক্ষক“বুদ্ধি ও পর্য্যবেক্ষন-নির্ভর” জ্ঞান থেকে অনেক ভালো মতামত দিতে পারবেন । বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রধান যে তিনটি বিষয় প্রয়োজন তা হচ্ছেঃ (০১) ভালো মানের শিক্ষক, (০২) ভাল মানের ছাত্র এবং (০৩) ভালভাবে পাঠদান ও পরীক্ষন । এর পরে যা প্রয়োজন তা হলো, (০৪) শিক্ষাদানের পরিবেশ ও (০৫) সহায়ক জিনিসপত্র । “শিক্ষন বিদ্যা” তাদের জন্যই প্রয়োজন যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম এবং যারা নীচের শ্রেনীতে পড়ান । বাচ্চাদের স্কুলে পড়ানোর সময় তাদের মানসিক অবস্থা জেনে বুঝে শিক্ষা দিতে হয় । আবার যারা এসব স্কুলে পড়ান তাদের শিক্ষাও তেমন বেশী নয় । তাই তাদের “শিক্ষন বিদ্যা”য় শিক্ষা বা প্রশিক্ষনের প্রয়োজন আছে । সেই তূলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতা করতে আসেন তাদের থাকে সর্বোচ্চ একাডেমিক শিক্ষা, আর পড়ান ১২ বৎসর স্কুলে (ও কলেজে) পড়া পরিপক্ক ছাত্রদের । তাছাড়া বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধীত বিষয় এমনিতেই যথেষ্ট কঠিন । এখানেও যদি তাদের সব পরিপক্ক ছাত্রদের মনোভাব লক্ষ রেখে পড়াতে হয় তাহলে পড়ানোর মান অবশ্যই খারাপ হবে । তবে আমরা জানি, বিদেশের “শিক্ষন বিদ্যা”য় ডিগ্রী নেয়া শিক্ষকদের শক্ত সংগঠন আছে । আর তারা সেমিনারে সকলকেই এ বিষয়ে প্রশিক্ষনের গুরুত্বের কথা বলে থাকেন । যদি এ বিষয়টিকে সত্য বলেও ধরে নি, তাহলেও বলতে হবে, শিক্ষা একটি দেশ ও সমাজ নির্ভর বিষয় । তাই এ বিষয়ে বিদেশী বা বিদেশে প্রশিক্ষিতদের সরাসরি এদেশে অবদান রাখার তেমন সুযোগ নেই ।
শিক্ষকঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেমন হওয়া প্রয়োজন তা আগেই কিছুটা বলা হয়েছে । বিশ্ববিদ্যালয় হচ্চে জ্ঞানের সর্বোচ্চ পীঠস্থান । শিক্ষকরা যে এখানে শুধু ছাত্র পড়াবেন তাই নয়, ছাত্ররা ভবিষ্যতে কি পড়বে তাও তারা তৈরী করবেন । এজন্য দরকার গবেষনা । এসব কাজ তারাই পারবে যারা আগাগোড়া ভালো ছাত্র । হঠাৎ করে কোন পরীক্ষায় ভালো ফল করে ফেলা ছাত্র দিয়ে এ কাজ হবে না । আগেই বলা হয়েছে, এখানে অধীত বিষয় বেশ কঠিন । ধরে নেয়া যায়, কেবলমাত্র একজন ভালো ছাত্রই এসব কঠিন বিষয় বুঝবে এবং ছাত্রদের ভালোভাবে বোঝাতে পারবে । যে শিক্ষক নিজেই বিষয় ভালো ভাবে বোঝে নি বলে ভালো ফল করতে পারে নি সে ছাত্রকে কি বোঝাবে ? “শিক্ষন বিদ্যায়” উচ্চতম ডিগ্রী বা প্রশিক্ষন পেলেও তার ঐ যোগ্যতা জন্মাবে না । তার পরেও সন্দেহমুক্ত হবার জন্য শিক্ষকদের প্রথম নিয়োগের সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কথা বলার ক্ষমতা এবং কোন বিষয় বুঝিয়ে বলার দক্ষতার পরীক্ষা নিয়ে থাকেন । এর পর তার উচ্চতর পদ নির্ভর করে তার গবেষনা কর্মের উপর, ছাত্র পড়ানোর উপর নয় । বিদেশে ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষক মূল্যায়নের যে নিয়ম আছে এ সম্বন্ধে আমাদের অনেকেরই ধারনা ভূল । আসলে বিদেশে শিক্ষক ছাত্র রেশিও ঠিক রাখার জন্য উচ্চতর শ্রেনীর ছাত্রদের সহায়ক শিক্ষক হিসেবে রাখা হয় । কর্তৃপক্ষ এদের কাউকে স্থায়ী নিয়োগ দেবে । এদের বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা জানার জন্য তারা ছাত্রদের মূল্যায়নের উপরনির্ভর করেন ।
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সরকার নির্ধারিত নিয়ম আছে । রাজনৈটিক হস্তক্ষেপ বা পরীক্ষকের সততার অভাব না হলে এভাবে ভালো শিক্ষক পাওয়া সম্ভব । প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব নিয়ম প্রয়োগ করে থাকে, তাই এদের মান সম্বন্ধে কিছু বলা যাচ্চে না ।
অনেকে ছাত্রপ্রিয়তাকে শিক্ষক বিচারের মানদন্ড হিসেবে ধরে থাকেন । এটি একেবারেই ভূল । ভালো না পড়িয়েও একজন শিক্ষক নীচের কারনে ছাত্রপ্রিয় হতে পারেন ঃ (১) মুখস্থ করে উত্তর দেয়া যায় ছাত্রদেরকে এমন নোট সরবরাহ করা, (২) সম্ভাব্য প্রশ্ন দিয়ে দেয়া, (৩) ছাত্র সহায়ক ক্লাশ টেস্ট নেয়া এবং সর্বশেষে (৪) দরাজ হাতে নম্বর দেয়া । আবার অনেকে মনে করেন, যে শিক্ষকের পড়ানো ছাত্রদের কাছ আকর্ষনীয়, তিনিই ভাল শিক্ষক । এটিও আংশিক ভূল । কিছু কিছু বিষয় আছে (যেমন, সাহিত্য, কলা, বানিজ্য ইত্যাদি) যেখানে মজা করে পড়ানো সম্ভব । কিন্তু বিজ্ঞান বা প্রকৌশল বিষয়ে এমন মজা করে পড়ানোর বিষয় খুব বেশী নেই । এখানে একজন শিক্ষকের কৃতিত্ব, শুধুমাত্র কঠিন বিষযটিকে সহজ করে বোঝানো, যা কেবল ভালো ছাত্রদের পক্ষেই সম্ভব। এমন বাস্তবতায় কোন বিষয়ে ভর্তি হবার আগেই ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে জেনে নেয়া উচিত ।
এখানে খন্ডকালীন শিক্ষক সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন । বর্তমানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন তাদের নীচের বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে হয় ঃ (১) নির্দিষ্ট সংখ্যক বক্তৃতার মাধ্যমে কোর্স শেষ করা, (২) ছাত্ররা যাতে খুশী থাকে এমন ব্যবস্থা করা, (৩) কর্তৃপক্ষ যেন পরবর্তীতে নিয়োগ দান করেন এমনভাবে কাজ করা । এর সবগুলিই উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে বিরূপ ভুমিকা রাখতে পারে । সংক্ষেপে বলা যায় ঃ উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রথম প্রয়োজন এমন শিক্ষক যার একাডেমিক ফলাফল আগাগোড়া ভালো, যিনি গবেষনা করতে পারেন এবং যার নিয়োগ অস্থায়ী নয় ।
ছাত্রঃ
উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে দ্বিতীয় প্রয়োজন, (বিশেষতঃ কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ন বিষয়ে ভর্তির জন্য) ভালো ছাত্র । কেবলমাত্র ক্লাশের সব বা অধিকাংশ ছাত্র ভাল হলেই শিক্ষকের পক্ষে কঠিন বিষয় যথাযথ ভাবে পড়ানো সম্ভব । ধরা যাক, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ ৩.০ (৫.০ স্কেলে) পেলেই ভর্তি হওয়া যায় । এই ছাত্রদের সবাই বা অধিকাংশ ফেল করবে এটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষের পক্ষে কোনক্রমেই মেনে নেয়া সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে শিক্ষককে কোর্স সংক্ষেপ, সহজীকরণ বা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতে হয় । এই শ্রেনীতে কোন ভালো ছাত্র থাকলে ভালো ফলাফল নিয়ে পাশ করলেও সে কিন্তু অসম্পূর্ণ জ্ঞান নিয়ে পাশ করবে এবং সম্ভবতঃ প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তেমন ভালো করতে পারবে না । এর কারন বোঝা কঠিন নয় ।
ভালো ফল নিয়েও একজন ছাত্র অত্যন্ত খারাপ হতে পারে যদি সে কোচিং সেন্টারে পড়াশনা করে থাকে । কোচিং সেন্টারের সমস্যা ঃ (১) প্রথমতঃ এরা সীমিত প্রশ্নের খুব ভালো করে তৈরী করা উত্তর সরবরাহ করে, যা মুখস্থ করে ছাত্ররা ভালো নম্বর পায়, কিন্তু তাদের শিক্ষা অসম্পূর্ন থাকে । (২) দ্বিতীয়তঃ ছাত্ররা সব জিনিস হাতের কাছে তৈরী পায় বলে পরবর্তীতে জ্ঞান আাহরনের জন্য কষ্ট করতে চায় না । মূলতঃ এই কারনেই আমাদের দেশের অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরী ক্লাশ নোট দেবার নিয়ম চালু হয়েছে । সংক্ষেপে বলা যায় ঃ উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন এমন ছাত্র যাদের সবাই বা অধিকাংশ পাবলিক পরীক্ষায় ভালো এবং যারা কোচিং সেন্টারে পড়ে নি । সেই সঙ্গে, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য দেশের সব কোচিং সেন্টার যত তাড়াতারী সম্ভব বন্ধ করে দেয়া উচিৎ ।
কোর্স কারিকুলামঃ
কোর্স কারিকুলাম দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান তেমন একটা নির্ধারন করা যায় না । সব বিশ্ববিদ্যালয়ই এগুলি ভালো দেখানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে থাকে । বলা যায়, নিকৃষ্টতম বিশ্ববিদ্যালয়টি সর্বোচ্চমানের কোর্স কারিকুলাম দেখানোর চেষ্টা করে থাকে । অনেকে আবার পটভুমি বিবেচনা না করেই বিদেশী কোর্স কারিকুলাম দেখিয়ে থাকে । প্রকৌশল বিষয় যারা পড়াইয় তারা বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) এর কোর্স কারিকুলাম অনুসরন করতে নিরাপদ বোধ করে । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোর্স কারিকুলাম তৈরী ও উন্নয়নের জন্য সরকার নির্ধারিত নিয়ম আছে । প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ের নিয়মগুলি এখনো আলাদা আলাদা রকমের । তবে এ বিষয়ে শেয কথা হলো ঃ কোর্স কারিকুলাম দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান নির্ধারন করা সম্ভব নয় । বরং এটা নির্ধারন করতে হয় কোর্স কারিকুলাম কিভাবে পড়ানো হয় তার ভিত্তিতে ।
প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন তৈরী করাঃ
প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন বা এলামনাই তৈরী করার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন নিয়ম করে রেখেছে । তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এটি তৈরীতে তেমন উৎসাহী নয় । অথচ প্রকৃত সত্য এই যে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এটি হচ্ছে একেবারে অব্যর্থ পন্থা । প্রাক্তন ছাত্রদের বিশেষ সুবিধা, তারা তাদের প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে কোন চাপ ছাড়াই যে কোন কথা বলতে পারে । আবার তারা যেহেতু বাজারে চাকুরী, কাজ বা উচ্চশিক্ষায় ভর্তির জন্য চেষ্টা করে চলেছে তাই তারা জানে, তাদের শিক্ষা বা সার্টিফিকেট এ সব বিষয়ে কতটা সহায়ক হচ্ছে । বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এ বিষয়ে একটু অন্যভাবে এগিয়ে আসতে পারে । তারা নিয়ম করতে পারে যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছাত্রদের কাছ থেকে ছাত্র প্রতি একটি নির্দিষ্ট হারে এলামনাই ফি তাদের একটি একাউন্টে জমা দিতে হবে । ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা বৎসরে অন্ততঃ দুই বার সম্মেলনে মিলিত হয়ে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে মতামত এবং উন্নয়নকল্পে তাদের প্রস্তাব জানাবে । এই প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে জমা দেয়া হলে তাদের বাবদে প্রাপ্ত ফি আনুপাতিক হারে তাদেরকে দিয়ে দেয়া হবে । বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এই তথ্য প্রকাশ্যে জানাবে এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রস্তাব বাস্তুবায়নের জন্য চাপ দেবে । সংক্ষেপে বলা যায়, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, চাকুরীর বাজারে দাম ও উচ্চ শিক্ষায় তাদের গ্রহনযোগ্যতা নির্নয়ের সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ হচ্ছে, তাদের প্রাক্তন ছাত্রদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে মতামত ও উন্নয়ন প্রস্তাব জানা ।
বুয়েট-এর শিক্ষন পদ্ধতিঃ
প্রসঙ্গেক্রমে বুয়েট-এর শিক্ষন পদ্ধতি আলোচনা করা যেতে পারে । বহু বৎসরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বুয়েট এমন একটি শিক্ষন পদ্ধতি চালু করেছে, যাকে প্রকৌশল বিষয়ে দেশে সর্বোত্তম বলা যায় । বুয়েট-এর শিক্ষন পদ্ধতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি এখানে আলোচনা করা যেতে পারে । এগুলি হচ্ছে, (০১) বুয়েট শিক্ষক নিয়োগের সময় আবেদনকারীদের মাঝ থেকে বিশেষ কোন কারন না থাকলে সর্বোচ্চ মেধার ছাত্রকে নিয়োগ করে থাকে । সবার জানা আছে, এ বিষয়ে তারা কোন রাজনৈতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে না । (০২) বুয়েট শুধুমাত্র সর্বোচ্চ মেধার বা ফলাফলধারী ছাত্রদের ভর্তি করে থাকে । এর বাইরে আর যেসব কারণ আছে তা হলো (০৩) তাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, (০৪) কোর্স কারিকুলাম এবং (০৪) ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষন পদ্ধতি ।
বুয়েট-এর একটি ঐতিহ্য আছে, যা অব্যাহত রাখার জন্য তার শিক্ষক বা ছাত্রদের উপর নৈতিক চাপ থাকে । আর তাদের ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষন পদ্ধতিতে আছে, (ক) শিক্ষক পাঠ্যবিষয়ের শুধুমাত্র কঠিন বিষয়গুলি ক্লাশে আলোচনা করে থাকেন । (খ) ক্লাশে কখনও সম্পুর্ন কোর্স পড়ানো হয় না এবং। (গ) ছাত্রদের কোন ক্লাশ নোট দেন না ।
সম্পুর্ন কোর্স না পড়ানোর কারনে ছাত্রদের লাইব্রেরীর সাহায্য নেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে । সৌভাগ্যবশতঃ বুয়েটের আছে নানা ধরনের সমৃদ্ধ লাইব্রেরী, যেমন, কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, ভাড়া প্রদানকারী ও ইন্টারনেট লাইব্রেরী । একটি মারাত্মক এবং একটি সাধারন ব্যাতিক্রমের কথা এখানে বলা যেতে পারে । প্রথমটি হলো, ঢাকায় এখন অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল বিষয় থাকায় বুয়েটের শিক্ষকগন সেখানে ভালো সুযোগ সুবিধায় খন্ডকালীন শিক্ষকতা করে থাকেন । বুয়েটের একজন বিভাগীয় প্রধানকে প্রশ্ন করা হয়েছিলে, এর ফলে বিয়েটে তাদের শিক্ষন ব্যহত হয় কি না । উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন তার মানে অনেকটা এরকম, ‘না, এতে বরং ভালো হচ্ছে । আগে আমার শিক্ষকরা সরাসরি ক্লাশে গিয়ে লেকচার দিত । এখন তাদেরকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে নোট তৈরী করে ছাত্রদের দিতে হয় । তারা সেই নোট বুয়েটের ছাত্রদের দিয়ে থাকেন । এর ফলে তারা বেশী উপকৃত হয় ।“ একটু গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখলে বোঝা যায়, এটি সম্পূর্ন ভূল ধারনা । বুয়েটের শিক্ষককে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে তুলনামূলকভাবে খারাপ ছাত্রদের জন্য সহজ করে প্রায় সম্পূর্ন কোর্সের নোট দিতে হয় । এই নোট বুয়েটের ছাত্রদের দেয়া হলে তাদের শিক্ষার মান দারুনভাবে ব্যহত হতে বাধ্য । দ্বিতীয় ব্যতিক্রমটি হচ্ছে, বুয়েটের কিছু ছাত্র খুব ভালো করে ক্লাশ নোট তৈরী করে, তার পর “চোথা” নামে এগুলি কপি করে বিক্রী করে । তবে এটি শিক্ষার মানে তেমন প্রভাব ফেলেনি । কারন শিক্ষকরা ইচ্চাকৃত ভাবেই সব কোর্স পড়ান না । সুবিধার মধ্যে যে সব ছাত্র কোন কারনে ক্লাশে নোট নিতে পারে নি তারা এ থেকে উপকৃত হয় । একটা কথা প্রচলিত আছে যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ছাত্র পড়ানোর জন্য এই চোথা ব্যবহার করেন ।
পরীক্ষায় পাশ ও ফেলঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাশ বা ফেল একটি সাধারন ঘটনা । কোন কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ফেলের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করে থাকে । এরা তাদের “সব বা অধিকাংশ ছাত্র পরীক্ষায় পাশ করে” এমন খবরকে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করতে চায় । এটিও মারাত্মক ভুল । গভীর ভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এটা আসলে ঐ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার নিম্ন মানের পরিচায়ক হতে পারে । শিক্ষকদের চাপ দেয়া হলে কিভাবে ছাত্রদের পাশ করিয়ে দিতে হবে তা তারা ভালোই জানে ।
ঊপসংহারঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান জানা বা তার উন্নয়নের জন্য তথ্য সংগ্রহ করা “কোয়েশ্চেনেয়ার” এর মাধ্যমে কিছুসংক্ষক শিক্ষকের মতামত সংগ্রহের চেয়ে অনেক কঠিন কাজ । যাই হোক, উপসংহারে এই প্রবন্ধে এই বিষয়ে উন্নয়নের জন্য যে সব কথা বলেছি, সেগুলি সংক্ষেপে উপস্থাপন করব ।
(০১) উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রথম প্রয়োজন এমন শিক্ষক যার একাডেমিক ফলাফল আগাগোড়া ভালো, যিনি গবেষনা করতে পারেন এবং যার নিয়োগ অস্থায়ী নয় ।
(০২) উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে প্রয়োজন এমন ছাত্র যাদের সবাই বা অধিকাংশ পাবলিক পরীক্ষায় ভালো এবং যারা কোচিং সেন্টারে পড়ে নি ।
(০৩) উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য দেশের সব কোচিং সেন্টার যত তাড়াতারী সম্ভব বন্ধ করে দেয়া উচিৎ ।
(০৪) কোর্স কারিকুলাম দিয়ে উচ্চশিক্ষার মান নির্ধারন করা সম্ভব নয় । বরং এটা নির্ধারন করতে হয় কোর্স কারিকুলাম কিভাবে পড়ানো হয় তা দিয়ে ।
(০৫) ভাল শিক্ষার জন্য ভালো মানের লাইব্রেরী একান্ত প্রয়োজন ।
(০৬) কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, চাকুরীর বাজারে দাম ও উচ্চ শিক্ষায় তাদের গ্রহনযোগ্যতা জানার সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ হচ্ছে, তাদের প্রাক্তন ছাত্রদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে মতামত ও উন্নয়ন প্রস্তাব জানা ।
আমাদের দেশের অনেক ব্যর্থতা স্বত্তেও প্রাইমারী ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নিঃসন্দেহে বিপ্লব এসেছছ । এ থেকে বলা যায়, সময় এসেছে, উচ্চ শিক্ষায়ও বিপ্লব আনার । এ বিষয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকেও সাম্প্রতিক কালে সহায়তাও আসছে । সেই সঙ্গে আসেছে এই টাকা কি ভাবে খরচ করা যায় এ সব সম্বন্ধে অযাচিত উপদেশ। আমার মনে হয়, বিদেশের অনুদানের বা ধারের টাকা ছাড়াই দেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে এবিষয়ে অনেক ভালো ভালো কাজ করা সম্ভব । তবে সেটা সম্পূর্ন রূপে নির্ভর করে সরকারের সিদ্ধান্তের উপর।
অধ্যাপক বিজন বিহারী শর্মা । স্থাপত্য বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় । ঢাকা ।
No comments:
Post a Comment